পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে পারেন এখান- মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি–১, এই যাত্রার শেষ কোথায়?
আপনি নিশ্চয়ই সিলেট থেকে ঢাকার দূরত্বটা ইঞ্চিতে মাপতে চাইবেন না।
এই দূরত্ব মাপতে হলে আপনাকে কিলোমিটার বা মাইলে মাপতে হবে।
কারণ পরিসর যত বেশি তার পরিমাপের একক তত বড়ো হতে হবে, তবেই মাপতে সুবিধে।
জ্যোতির্বিদ্যার পরিসর আমাদের চেনাজানা পরিবেশ থেকে অনেক অনেক বড়ো।
তাই এখানে সময় ও দূরত্বের বিশাল বিশাল একক ব্যবহার করা হয়।
কিলোমিটার বা মাইলে নয়, এখানে দূরত্বের পরিমাপ হয় আরও বড়ো এককে। এমন কয়েকটি এককের সাথে আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই :
আলোর গতিবেগ হচ্ছে সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার। এই বিপুল গতিবেগ নিয়ে আলো ১ বছরে যতটুকু দূরত্ব পাড়ি দেয় সেটাকেই ১ আলোকবর্ষ বলে।

কথা হচ্ছে আলো ১ বছরে ঠিক কতটা পথ পাড়ি দেয়? হিসেব করে দেখা গেছে আলো এক বছরে পাড়ি দেয় 9×10¹² কিলোমিটার বা নয় মিলিয়ন মিলিয়ন কিলোমিটার!
এভাবে বললে অনেকেরই মাথায় ঢুকবে না, তাই একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝাই :
পৃথিবীর পরিধি হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার। তো, আলোকে পৃথিবীর চারপাশে চক্কর দিতে বললে সে ১ সেকেন্ডের মধ্যেই সাতবারের বেশি পৃথিবীকে চক্কর দিয়ে আসবে!
পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব প্রায় ৩ লক্ষ ৭১ হাজার কিলোমিটার, তার মানে আলো পৃথিবী থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে পৌঁছুতে দেড় সেকেন্ডও লাগবে না!
পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। আলো এই দূরত্ব পাড়ি দিতে সময় নিবে মাত্র ৮ থেকে সাড়ে ৮ মিনিট!
সৌরজগতের দূরতম গ্রহ প্লুটো হচ্ছে একটি বামন গ্রহ। সূর্য থেকে এর দূরত্ব ৫৯০ কোটি কিলোমিটার। কিন্তু এই অভাবনীয় দূরত্বও পাড়ি দিতে আলোর লাগবে মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা!
সূর্য থেকে প্লুটোর যে দূরত্ব, সেই দূরত্বকে ১৬০০ বার গুণ করলে যে বিশাল রাস্তা তৈরি হবে, সেই রাস্তাকেই এক আলোকবর্ষের দূরত্ব বলা যায়। আলোর এই দূরত্ব পাড়ি দিতে ১ বছর সময় লাগবে। এবার হয়তো কিছুটা বুঝতে পারছেন ১ আলোকবর্ষ মানে ঠিক কতটা দূরত্ব?
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের সৌরজগতের ভেতর দূরত্বের হিসেব কষার ক্ষেত্রে আলোকবর্ষের এককটা ঠিক খাটে না, এরজন্য আলোকবর্ষের চাইতে ছোটো এককের দরকার। ঠিক এই কারণে শুধু সৌরজগতের ভেতর দূরত্ব পরিমাপের জন্য আরেকটা একক আছে। সেটাকে বলে ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট’। সংক্ষেপে- AU.
পৃথিবী থেকে সূর্যের যে দূরত্ব সেই দূরত্বকে ১ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট ধরা হয়।

সেই হিসেবে সূর্য থেকে সৌরজগতের সর্বশেষ গ্রহ প্লুটোর দূরত্ব সাড়ে ৩৯ অ্যাস্টোনমিক্যাল ইউনিট। এবং প্রায় ৬০ হাজার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিটে হয় ১ আলোকবর্ষ।
জ্যোতির্বিদরা প্রায়শই আলোকবর্ষের বদলে আরেকটি একক ব্যবহার করেন, যাকে ‘পারসেক’ বলা হয়। ১ পারসেক মানে ৩.২৬ আলোকবর্ষ। পারসেকের হিসেবটা কীভাবে আসে সংক্ষেপে বলি :
চোখের সামনে একটা আঙুল ধরুন, এবার প্রথমে ডান চোখ বন্ধ করে বাম চোখ দিয়ে আঙুলটা দেখুন। তারপর আবার বাম চোখ বন্ধ করে ডান চোখ দিয়ে আঙুলটা দেখুন। কী ঘটছে সেটা নিজেই বুঝতে পারবেন।
বাম চোখ বন্ধ করে তাকালে আঙুলটাকে একটু বামে সরতে দেখবেন। আবার ডান চোখ বন্ধ করে তাকালে আঙুলটাকে একটু ডানে সরতে দেখবেন। লক্ষ করবেন আঙুলটা চোখের কাছে নিয়ে এলে পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডের সাপেক্ষে আঙুলের ডানে-বায়ে সরে যাওয়া বেড়ে যাচ্ছে। এবং আঙুল দূরে নিলে সরে যাওয়াটাও কমে যাচ্ছে। এই ঘটনাকে বলা হয় প্যারালাক্স।

তো, এই পর্যবেক্ষণ থেকে কী কী বেরিয়ে আসে দেখি :
চোখ দুটো আসলে আলাদা দুটো ভিউপয়েন্ট।
একটা বস্তু ভিউপয়েন্টের যত কাছে আসবে ভিউপয়েন্ট পরিবর্তনের সাথে তার অবস্থান পরিবর্তন অর্থাৎ কৌণিক বিচ্যুতিও তত বাড়বে। দূরে গেলে কমবে।
দুটো ভিউপয়েন্টের (যেমন এক চোখ থেকে অন্য চোখের) মধ্যবর্তী দূরত্ব যত বেশি হবে কৌণিক বিচ্যুতি ততই স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। তাই নক্ষত্রের দূরত্ব বের করার সময় হিসেবের সুবিধার জন্য পৃথিবীকে একটি ভিউপয়েন্ট এবং সূর্যকে আরেকটি ভিউপয়েন্ট ধরা হয়।
কোনো বস্তুর দূরত্ব জানতে হলে দুটো ভিউপয়েন্টের মধ্যকার দূরত্ব এবং দুটো ভিউপয়েন্ট থেকে ওই বস্তুতে যে কোণ উৎপন্ন হয় তার মাপ জানা থাকতে হবে। কোণ পরিমাপ করার যন্ত্রকে ‘সেক্সট্যান্ট’ বলে। এটা নিয়ে আরেকদিন লিখব।
একটি নক্ষত্র বছরে ১ আর্কসেকেন্ড পরিমাণ কৌণিক বিচ্যুতি ঘটালে সেই নক্ষত্রটি ১ পারসেক বা ৩.২৬ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে।
বছরে ০.৫ আর্কসেকেন্ড পরিমাণ কৌণিক বিচ্যুতি ঘটলে ধরে নিতে হবে নক্ষত্রটি ২ পারসেক দূরে রয়েছে। নক্ষত্র যত দূরে থাকে তার কৌণিক বিচ্যুতি তত কম হয়।
৩৬০ ডিগ্রি মিলে হয় একটি বৃত্ত। এবং ১ আর্কসেকেন্ড হলো ১ ডিগ্রির ৩৬০০ ভাগের মাত্র এক ভাগ। বোঝাই যাচ্ছে এটি খুবই ক্ষুদ্র একটি একক।
প্যারালাক্স পদ্ধতি প্রয়োগ করে ৬৫০ আলোকবর্ষের মধ্যকার যে কোনো বস্তুর দূরত্ব পরিমাপ করা যায়।
• ১ মিলিয়ন পারসেককে ১ মেগাপারসেক বলা হয়।
সূর্যের পর আমাদের সবচেয়ে কাছের স্টার সিস্টেম হলো আলফা সেন্টুরি। এর কৌণিক বিচ্যুতি হলো বছরে ০.৭৫ আর্কসেকেন্ড। তার মানে হচ্ছে আলফা সেন্টুরি আমাদের থেকে ১.৩৩ পারসেক বা ৪.৩৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
পরবর্তী পর্ব পড়তে পারেন- মহাবিশ্বের অন্তিম পরিনতি-৩, মিল্কিওয়ে, আমাদের নক্ষত্রবাড়ি
Pingback: মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি–৩, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, আমাদের নক্ষত্রবাড়ি - অক্ষর