একমাত্র মানবসম্প্রদায়ের মধ্যেই কিছু জিনিয়াসের দেখা মেলে, যারা পাগলামির সীমা অতিক্রম করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে! এই জিনিয়াস পাগলদের জন্যই বিজ্ঞান আজ লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড়সম উচ্চতায় পৌঁছে গেছে! দিনশেষে এই অভাবনীয় উৎকর্ষের পেছনে কিছু একগুঁয়ে, পাগলাটে, কাজপাগল ও ভূলোমনা মানুষদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তাইতো কোনো এক পাগল হঠাৎ আনমনে গেয়ে উঠেছিলেন–বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের মেলা!
প্রকৃতিবিদ উইলিয়াম বিবে, ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি নিয়ে বারমুডার ননসাচ দ্বীপে একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। উনার লক্ষ্য ছিল এখানকার গভীর সমুদ্রের ৮ বর্গমাইলের ভেতর যেসব প্রাণী আছে সেগুলোর ওপর রিসার্চ করা। সমুদ্রের গভীরে কী সব প্রাণী আছে সেগুলো জানার জন্য উনার মন খুব টানত। কিন্তু তখনকার দিনে জানালাবিহীন সাবমেরিনগুলো নামতে পারত ৩৮৩ ফুট অবদি! আর ভারী স্যুট-বুট পরে কোনো ডুবুরি ঝাপ দিতে পারত ৫২৫ ফুট পর্যন্ত, কিন্তু ভারী স্যুটের কারণে যেখানে নড়াচড়া করাই কষ্টকর সেখানে রীতিমতো পর্যবেক্ষণ করে ডাটা কালেক্ট করার স্বপ্ন দেখা তো বিলাসিতা। সুতরাং গভীর সমুদ্র লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাচ্ছিল। অনেক চিন্তাভাবনার পর উইলিয়াম বিবের মাথায় ক্যাপসুল আকৃতির একটি সিলিন্ডারের নকশা আসে, যার ভেতরে বসে গভীর সমুদ্র পর্যবেক্ষণে যাওয়া যেতে পারে। তিনি এই ধারণাটি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় আর্টিকেল আকারে প্রকাশ করেন। এই আর্টিকেলটি আরেক পাগলাটে ইঞ্জিনিয়ার ওটিস বার্টনের চোখে পড়ে যায়।
তিনি উইলিয়াম বিবেকে মেইলে জানিয়ে দিলেন–এত প্রচণ্ড চাপ ক্যাপসুল আকৃতির এই স্ট্রাকচার সহ্য করতে পারবে না। এবং এর সাথে বিকল্প কিছু নকশার আইডিয়াও পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু বিবের কাছে মেইল মারফত আরো প্রচুর আইডিয়া আসছিল। ফলস্বরূপ বার্টনের আইডিয়া সেগুলোর নিচে চাপা পড়ে যায়! অবশেষে এক মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের মাধ্যমে দুজনের পারষ্পরিক যোগাযোগ হয় এবং তারা একটি চুক্তি অনুসারে একসাথে কাজ করতে রাজি হলেন! চুক্তিটা হলো-
ওটিস বার্টন উনার জাহাজে করে উইলিয়াম বিবেকে নিয়ে যেখানেই সমুদ্র অভিযানে যান না কেন, সেই সব অভিযানের জাহাজের ভাড়া এবং সব খরচাপাতি উইলিয়াম বিবেকেই বহন করতে হবে।
তারপর? তারপর আর কী? একজন কাজপাগল প্রকৃতিবিদ এবং আরেকজন কাজপাগল ইঞ্জিনিয়ার একত্র হয়ে প্রথমেই গভীর সমুদ্রে যাওয়ার মিশনে নেমে পড়লেন।
১৯৩২ সালের ঘটনা। তাঁরা ব্যাথিস্ফিয়ার নামক একটি গোলাকার বস্তু বানালেন যার ভেতরে বসে রহস্যময় গভীর সমুদ্রের ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার ভেতরটায় উঁকি দেওয়া যাবে! এই গোলাকার আকৃতির ব্যাথিস্ফিয়ারের উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট, সমুদ্রতল পর্যবেক্ষণের জন্য তিন ইঞ্চি পুরো ‘ফিউজড কোয়ার্টজ’ নামক বিশেষ কাঁচের তৈরি ছোটো গোলাকার জানালা লাগানো ছিল। এই জানালার ওপর একটা স্পটলাইট বসানো ছিল গভীর অন্ধকার সমুদ্র দেখার জন্য। আর ছিল একটি দরজা।
সমুদ্রের নিচে যাবার কথা উঠলেই সবার আগে চলে আসে এর অসহ্য চাপের কথা, কথা হলো গভীর সমুদ্রে আসলে কী রকম প্রেশার? তাহলে আলোচনাটা সমুদ্রের ওপরিভাগ থেকেই শুরু করি। সমুদ্রপৃষ্ঠে, মানে সমুদ্রের পানি যে উচ্চতায় আছে সেখানে প্রতি বর্গইঞ্চিতে বাতাসের চাপ ১৪.৭ পাউন্ড, এর মানে সবদিক থেকে বাতাস আমাদের শরীরকে ১৪.৭ পাউন্ড প্রেশারে ঠেলছে, এটাকে বলে ১ বায়ুমণ্ডলীয় প্রেশার। তাহলে এই প্রেশারে আমরা কুঁকড়ে যাচ্ছি না কেন? কারণ আমাদের দেহের ভেতরের রক্ত-পানি আর কলকব্জাও ভেতর থেকে একই প্রেশারে বাতাসকে ঠেলছে, এই ভেতরের আর বাইরের ঠেলাঠেলিতে আমরা এখন সাম্যাবস্থার আছি, কোনো প্রেশার ফিল করছি না। (কথাটা আসলে হবে–“বাতাসের কোনো প্রেশার ফিল করছি না।” এছাড়া নিত্যদিনের প্রেশার, বিভিন্ন টেনশনের প্রেশার, ফ্যামিলির প্রেশার, গ্র্যাভিটির টানে পায়ের ওপর সারা শরীরের প্রেশার তো প্রতিনিয়তই ফিল করে যাচ্ছি!!!)
যাইহোক, আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যতই নিচে নামব ততই আমাদের শরীরের ভেতরের প্রেশারের তুলনায় চারপাশের সমুদ্রের পানির প্রেশার শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আপনি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৩ ফুট নিচে গেলে আপনার ওপর সে যে প্রেশার দিবে সেটা সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রেশারের দ্বিগুণ। প্রতি ৩৩ ফুট নিচে যাওয়ার সাথে সাথে ১ বায়ুমণ্ডলীয় প্রেশার যোগ হবে। সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর খাদ মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা ৩৬,২০১ ফুট। এই জায়গায় প্রতি বর্গইঞ্চিতে ৮ টন প্রেশার। এই ভয়াবহ প্রেশারে আপনি কুঁচকে গুড়িয়ে পেস্ট হয়ে যাবেন।
তাহলে গভীর সমুদ্রতলে এত এত প্রাণী হেসে খেলে বেড়ায় কীভাবে? ওরা তো পচা পাইপের মতো চাপে পিষ্ট হয়ে ভেঙে গুড়িয়ে যায় না! আসলে এটাই সাইন্স। তিমির কথাই ধরা যাক, বেচারা মাছ না হয়েও তার প্রকাণ্ড শরীরটা নিয়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য ২০ হাজার ফুট গভীরে চলে যেতে পারে! কীভাবে সম্ভব ভাই? সম্ভব, কারণ হলো তার দেহের স্ট্রাকচার। তার ফ্লেক্সিবল দেহটা সমুদ্রের অধিকাংশ লেয়ারে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তার পাঁজরের জয়েন্ট পয়েন্টগুলো ঢিলেঢালা আর কার্টিলেজ নরম হবার কারণে সংকোচন–প্রসারণ ঘটে তাই প্রচণ্ড প্রেশারেও মানিয়ে যায়। এদিকে আমাদের শক্ত পাঁজর এত চাপ নিতে পারবে না, ফেটে যাবে।
আবার ব্যাথিস্ফিয়ারে ব্যাক করি। ব্যাথিস্ফিয়ারের ভেতরে ছিল প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেনের বোতল, যোগাযোগের জন্য টেলিফোন এবং আলোকিত করার জন্য লাইট। ওহহো, ভেতরে থাকা ব্যাক্তিদের থেকে নিঃসৃত কার্বন–ডাই অক্সাইড শোষণ করার জন্য সোডা, চুন এবং ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডের ট্রে ও রাখা ছিল। ব্যাথিস্ফিয়ারের সাথে বাঁধা থাকত ৩ হাজার ফুট লম্বা স্টিলের তার, যার অপর প্রান্ত সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের সাথে সংযুক্ত থাকত।
১৯৩০ সালের ২৭ মে ব্যাথিস্ফিয়ারের আবিষ্কারক ওটিস বার্টন এবং প্রকৃতিবিদ উইলিয়াম বিবে বারমুডা উপকূলে গিয়ে ব্যাথিস্ফিয়ারে চেপে পরীক্ষামূলকভাবে গভীর সমুদ্র থেকে ঘুরে আসেন। তারপর আসে ১৯৩২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিকেলের সেই মাহেন্দ্রক্ষ। ব্যাথিস্ফিয়ারে চড়ে মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১৫০০ ফুট নিচে নামেন দুজন। এর আগ পর্যন্ত মানুষ ডাইভিং স্যুট-বুট পরে বা সাবমেরিনে করে সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ শ ফুট অবদি নামতে পেরেছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের রেডিয়ো মাধ্যমে এই ঘটনাটির লাইভ সম্প্রচার করা হচ্ছিল এবং তারা সমুদ্রের ১৫০০ ফুট নিচে থেকে টেলিফোনে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তাঁদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সরাসরি বর্ণনা দিচ্ছিলেন। সেই বর্ণনা প্রথমে ব্যাথিস্ফিয়ার থেকে তারের মাধ্যমে ওপরে ভাসমান জাহাজের ট্রান্সমিটারে এবং সেখান থেকে সারাদেশে সম্প্রচার করা হয়।
গভীর সমুদ্র পর্যবেক্ষণের নেশা এই দুজনকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে পরবর্তী চার বছরে তারা আরো ৩০ বার গভীর সমুদ্রে নেমেছেন। স্বচক্ষে দেখে এসেছেন সেখানে বাস করা অদ্ভুত রহস্যময় সব প্রাণীদের, জেনেছেন তাদের বাস্তুতন্ত্র সহ আরো নানা বিষয়। ছিল প্রচণ্ড ঝুঁকি, ন্যূনতম ছোটো একটা ছিদ্র থেকেও মারাত্বক বড়ো দূর্ঘটনা ঘটতে পারত। কখনো কখনো উত্তাল সমুদ্রে তাড়াহুড়ো করে ব্যাথিস্ফিয়ার টেনে ওঠানোর সময় দুজন প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আহতও হয়েছেন। এসবে যেন তাঁদের মনোবল আরো বেড়ে যেত! ১৯৩৪ সালের ১১ আগস্ট তারা দুজন ২৫১০ ফুট গভীর পর্যন্ত নেমেছিলেন। ঠিক এর চারদিন পরই তারা আবার ৩০২৮ ফুট গভীরে ভ্রমণ করে আসেন। আর এর প্রায় ১৫ বছর পর বার্টন ৪৫০০ ফুট গভীরে গিয়ে নতুন রেকর্ড করেন।
প্রযুক্তির তুমুল অগ্রযাত্রায় ব্যাথিস্ফিয়ারের আজ প্রয়োজনীয়তা নেই, এর জায়গায় এসেছে অত্যাধুনিক সব সাবমার্সিবল। কিন্তু তাই বলে তো ভুলে গেলে চলবে না, রহস্যময় গভীর সমুদ্রে আলোর সার্চলাইট জ্বেলে চোখ মেলে তাকানোর ক্ষেত্রে এই ব্যাথিস্ফিয়ারই আমাদের অগ্রপথিক ছিল।
অসাধারণ হয়েছে!
ধন্যবাদ।